সংবাদ এই সময় ডেস্ক
দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পটিয়া উপজেলার শতাব্দী প্রাচীন হাট-বাজারগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। প্রাচীন এই হাটগুলো শুধু অর্থনৈতিক কেন্দ্র ছিল না, বরং স্থানীয় সংস্কৃতির আয়না যেখানে কৃষক-ব্যবসায়ীদের মিলনমেলা হত, লোকগান-কথকতা শোনা যেত এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্প্রদায়ের বন্ধন মজবুত হত। কিন্তু আধুনিকীকরণ, নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অভিবাসনের চাপে এই ঐতিহ্যবাহী হাটগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন। এক সময় এসব হাট ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র, মানুষের মিলনমেলা আর সামাজিক সংস্কৃতির আসর।কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া, শহরমুখী জীবনযাত্রা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে আজ সেই ঐতিহ্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরও পটিয়ার হাট-বাজারগুলো ছিল স্থানীয় অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। পণ্য বিনিময়ের পাশাপাশি এসব হাট ছিল লোকসংস্কৃতি, পালাগান, কথকতা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্রও।
স্থানীয় প্রবীণরা জানান, শান্তিরহাট, অলিরহাট, কান্তিরহাট, ভট্রাচার্য হাট, পুরাতন থানার হাটসহ আরো কয়েকটি পুরনো হাট এক সময় আশপাশের মানুষকে একত্র করত। সেখানে বিভিন্ন জিনিসের পসরা সাজানো থেকে শুরু করে লোকজ গান, পালাগান এমনকি রাজনৈতিক আলোচনা পর্যন্ত সবকিছুরই আসর বসত। এগুলো শুধু বাজার নয়, আমাদের পরিচয়ের অংশ। পটিয়া উপজেলার ইতিহাস ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে শুরু। ১৮৪৫ সালে এখানে প্রথম থানা প্রতিষ্ঠিত হয় যা ১৯৮৪ সালে উপজেলায় রূপান্তরিত হয়।
১৯৩০-এর দশকে যুগান্তর দলের বিপ্লবীদের আড্ডা এবং চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সূত্রপাতের স্থান হিসেবে পটিয়া ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়। এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে গড়ে ওঠা হাট-বাজারগুলো ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড।
উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুসারে, পটিয়ায় প্রায় ২০টিরও বেশি হাট-বাজার রয়েছে, যার মধ্যে অলির হাট, পটিয়া পুরাতন থানার হাট, কমলমুন্সির হাট, ঘোষের হাট, সফরআলী মুন্সির হাট, পাচুরিয়া জামে মসজিদ হাট, কান্তির হাট এবং বুধপুরা বাজারের মতো প্রাচীন কয়েকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলোর বেশিরভাগই সাপ্তাহিক হাট, যেখানে কৃষি উৎপাদন, পশু-পক্ষী, হস্তশিল্প এবং মৎস্যজাত পণ্যের বিনিময় হত।
স্বর্ণালী দিনের স্মৃতি কচুয়াই এলাকার অলির হাট পটিয়ার সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী হাটগুলোর একটি।
এক শ বছরেরও বেশি পুরনো এই হাটটি প্রতি মঙ্গলবার বসত, যা স্থানীয় সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কেন্দ্র ছিল। কৃষকরা তাজা সবজি, ফলমূল, নদীর মাছ এবং হস্তনির্মিত মাটির পাত্র-টুপি নিয়ে আসতেন। বিনিময় ব্যবস্থা এখানকার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যেখানে টাকা-পয়সার চেয়ে সম্পর্কের গুরুত্ব বেশি। লোকগান, কথকতা এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান এই হাটকে একটি সাংস্কৃতিক উৎসবের রূপ দিত। কিন্তু আজ এই হাট প্রায় নিস্তব্ধ।
২০১৭ সালের রোহিঙ্গা সংকটের পর থেকে ব্যবসায়ীদের বাস্তুচ্যুতি, আধুনিক সুপারশপের উত্থান এবং নদীভাঙনের কারণে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই কমে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে, ফলে হাটের স্থানীয় উৎপাদকরা অন্যত্র চলে গেছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই হাটে আমরা জন্ম থেকে ব্যবসা করছি, কিন্তু এখন ক্রেতা কমে গেছে। আগের দিনগুলো ছিল সোনার। লোকজনের ভিড়ে হাঁটতে গেলে ধাক্কা খেতাম, এখন তো দোকান খালি পড়ে থাকে।’
অলির হাটের কৃষক আবদুল করিম বলেন, ‘আধুনিক যুগের পরিবর্তনের কারণে আমাদের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। হাট ফিরে আসুক, নইলে আমাদের সন্তানরা এই গল্পগুলো কখনো শুনতেও পাবে না।’
পুরাতন থানার হাট বিপ্লবের সাক্ষী থেকে ধ্বংস হয়ে গেছে আরেকটি শতাব্দী প্রাচীন স্মৃতিচিহ্ন। ১৮৪৫ সালের থানা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এই হাট গড়ে ওঠে, যা বিপ্লবীদের গোপন সভার স্থানও ছিল। এখানে চাল-ডাল, পশুব্যবসা এবং স্থানীয় হস্তশিল্পের বাজার হতো।
স্থানীয় হাজী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এই হাট ছিল আমাদের হৃদয়। কিন্তু সরকারি উদ্যোগের অভাবে এখন এটা ধ্বংস হয়ে গেছে।’
কমলমুন্সির হাট (কচুয়াই), ঘোষের হাট (ধলঘাট), সফরআলী মুন্সির হাট (হাবিলাসদ্বীপ) এবং কান্তির হাটসহ একাধিক প্রাচীন বাজারও একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে। এক সময়ের সামাজিক মিলনকেন্দ্র এখন নিস্তব্ধ ও জনশূন্য।
বিশ্লেষকদের মতে, কয়েকটি কারণে আজ ঐতিহ্যবাহী হাটগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। নদীপথ ও কাঁচা রাস্তা নির্ভর বাণিজ্য বিলুপ্ত, ফলে হাটের প্রয়োজন কমেছে। সুপারশপ ও শহরমুখী কেনাকাটা যেমন-বড় দোকান ও শপিং হাব গ্রামীণ গ্রাহকদের টেনে নিচ্ছে। আবার, হাটে নেই স্যানিটেশন, নিরাপত্তা, আলো কিংবা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা। তরুণ প্রজন্ম চাকরি ও পড়াশোনার কারণে শহরে চলে যাচ্ছে ফলে হাটের ক্রেতা-সংখ্যা কমছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল গফুর বলেন, ‘আগে হাটের দিনে সকাল থেকেই হাজারো মানুষ আসত। এখন ভিড় নেই, সবাই শহরের দোকানেই চলে যায়।’
প্রবীণ বাসিন্দা ফজলুল হক স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘হাট মানেই ছিল উৎসব। সব পরিবার একসঙ্গে হাটে যেত। এখন সেই দিনগুলো কেবল স্মৃতি।’
স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী আবদুল্লাহ ফারুক রবি বলেন, ‘হাট হারালে শুধু অর্থনীতি নয়, আমাদের লোকজ ঐতিহ্যও হারিয়ে যাবে।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সঠিক উদ্যোগ নিলে এখনও এ ঐতিহ্য রক্ষা করা সম্ভব। হাটগুলোকে আধুনিক সুবিধা দিয়ে সংস্কার করা, স্থানীয় কৃষি ও হস্তশিল্প পণ্যের বাজার তৈরি, সাংস্কৃতিক আয়োজনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা এবং প্রশাসনিক সহযোগিতা বাড়ানো জরুরি।
জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সাবেক সদস্য সচিব নাছির উদ্দিন বলেন, ‘হারিয়ে যাওয়া পটিয়ার হাটগুলোকে ট্র্যাডিশনাল মার্কেট হিসেবে প্রমোট করতে হবে। তাতেই অর্থনীতি ও ঐতিহ্য দুটোই ফিরে আসবে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে রাস্তাঘাট সংস্কার, প্রচারণা এবং ডিজিটাল ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে এই হাটগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। এখনই উদ্যোগ না নিলে শতাব্দীপ্রাচীন এই স্মৃতিগুলো কালের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।’
পটিয়ার হাট-বাজারগুলো শুধু ব্যবসার স্থান নয়, সেগুলো ইতিহাসের সাক্ষী, সামাজিক বন্ধনের প্রতীক এবং গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ। যথাসময়ে পদক্ষেপ না নিলে হারিয়ে যাবে কেবল ব্যবসা নয়, হারিয়ে যাবে একটি সাংস্কৃতিক অধ্যায়ও।