সংবাদ এই সময় ডেস্ক
দেশের শীর্ষ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও স্বার্থের সংঘাত নিয়ে বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। ‘বাংলা আউটলুক’-এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির প্রধান সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এম শামসুর রহমান মোমেন, তার স্ত্রী সাবরিনা জামান, হেড অব নিউজ মামুন আব্দুল্লাহ, তার স্ত্রী রিফাতে এলাহী এবং টকশো উপস্থাপক আশিস সৈকতের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ তুলে ধরেছেন।
গোপনে দেশত্যাগ ও দুর্নীতির অভিযোগ
গত জুলাইয়ের শেষ দিকে দেশের পরিচিত এই মিডিয়া নির্বাহী মোমেন নীরবে দেশ ত্যাগ করেন। দুবাইগামী ফ্লাইটে তিনি ঢাকা ছাড়েন ঠিক সেই সময়, যখন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত চলছিল। কয়েকদিন পরই আদালত তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে—কিন্তু তখন পর্যন্ত তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন।
দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মোমেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তিনি বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে অনৈতিক আর্থিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। বেক্সিমকোর মালিকানাধীন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রভাব ব্যবহার করে তিনি বেক্সিমকো ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সংবাদ কাভারেজ প্রভাবিত করেছেন।
ইমপ্যাক্ট পিআর: ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার
তদন্তে আরও উঠে এসেছে, মোমেন ও তার স্ত্রী সাবরিনা জামান যৌথভাবে পরিচালনা করেন ‘ইমপ্যাক্ট পিআর’ নামের একটি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান। এই সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে রবি আজিয়াটা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ ও ইউনিলিভারসহ বড় করপোরেট কোম্পানির পিআর কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, এসব ক্লায়েন্টের খবর ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হতো, আর তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক খবর সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হতো।
একজন সাবেক সিনিয়র প্রযোজক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিনি নিউজরুমকে নিজের মার্কেটিং অফিসে পরিণত করেছিলেন। সবাই জানত, কোন কোম্পানির খবর প্রচার হবে, আর কোনটা হবে না।
গণমাধ্যমের নীতি লঙ্ঘন
মোমেন দম্পতি শুধু ইমপ্যাক্ট পিআর-ই নয়, আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত—‘ইনফোপাওয়ার লিমিটেড’, একটি পিআর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবং ‘ইনফোস্টেশন ডিজিটাল’, একটি বিজ্ঞাপন সংস্থা। অভিযোগ রয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির বিজ্ঞাপন বণ্টন ও প্রচারণা নিয়ন্ত্রণ করা হতো। অর্থাৎ, তারা একই সঙ্গে সংবাদ ও বিজ্ঞাপনের দুই দিক থেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন।
মিডিয়া বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি বলেন, যখন কোনো সংবাদকর্মী নিজের পিআর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লাভবান হন, তখন সংবাদ আর করপোরেট স্বার্থের সীমারেখা মুছে যায়। এটি সরাসরি সাংবাদিকতার নীতির পরিপন্থি।
তিনি আরও যোগ করেন, বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের সবচেয়ে বড় হুমকি এখন সেন্সরশিপ নয়—বরং করপোরেট প্রভাব। গণমাধ্যম এখন ব্যবসার স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে, জনগণের স্বার্থে নয়।
সহকর্মীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ
শুধু মোমেনই নন, তার সহকর্মীরাও এই অনৈতিক চক্রে যুক্ত বলে অভিযোগ উঠেছে।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির হেড অব নিউজ মামুন আব্দুল্লাহ ও তার স্ত্রী রিফাতে এলাহী পরিচালনা করেন ‘উইন্ডো মিডিয়া লিমিটেড’ নামের একটি পিআর প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ আছে, ওই প্রতিষ্ঠানের ক্লায়েন্টদের ইভেন্ট কভার করতে সাংবাদিকদের বাধ্য করা হতো, এমনকি অন্য গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পিছিয়ে দেওয়া হতো।
একজন প্রতিবেদক বলেন, ছাত্র আন্দোলনে হামলার খবর পেছনে রাখা হতো, কিন্তু কোনো করপোরেট ক্লায়েন্টের ইভেন্ট থাকলে সেটি সরাসরি সম্প্রচার করা হতো।
জুলাইয়ের আন্দোলনের সময় আলোচিত টকশো উপস্থাপক আশিস সৈকতও সমালোচনার মুখে পড়েন। তিনি সম্প্রচারে ছাত্র আন্দোলনকে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র ও বিশৃঙ্খলা’ বলে আখ্যা দেন—যা অনেকে সরকারের দমননীতিকে নৈতিক সমর্থন হিসেবে দেখেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, মোমেনের বিদেশযাত্রা নিষেধাজ্ঞার তথ্য আগেভাগেই ফাঁস হওয়ায় তিনি দেশ ছাড়তে সক্ষম হন। বর্তমানে তার বিদেশ সফর ও ব্যাংক লেনদেন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, করপোরেট বিজ্ঞাপনের ওপর মিডিয়ার নির্ভরতা নতুন নয়, কিন্তু যখন সম্পাদক ও ক্লায়েন্টের ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িয়ে যায়, তখন জনগণের আস্থা ধ্বংস হয়।
বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি বলেন, মোমেনের ঘটনা আমাদের জন্য এক বড় শিক্ষা। যখন ব্যক্তিগত ব্যবসা ও জনগণের বিশ্বাস একসঙ্গে মিশে যায়, তখন সাংবাদিকতা থাকে না।