আবদুল বায়েস
যদি বলা হয়, ক্যান্সার, হৃদরোগ বা অন্যান্য জটিল ও প্রাণঘাতী রোগের চেয়েও ভয়ংকর হচ্ছে বাল্যবিবাহ, তাহলে খুব একটা ভুল বলা হবে বলে মনে হয় না। এর কারণ বর্ণিত ঘাতক রোগে একজন আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু বা ক্ষতি ঘটে, অথচ এর বিপরীতে বাল্যবিবাহ একটা মেয়ে ও তার প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দেয়। গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো তথ্য হচ্ছে, পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় দেড় কোটি মেয়েকে ১৮ বছরে পৌঁছার আগেই বিয়ে দিয়ে অপমৃত্যুর ফাঁদে ফেলা হয়। তার অর্থ, প্রতি মিনিটে ২৮ জন এবং প্রতি দুই সেকেন্ডে একজন অবিবাহিত মেয়ে এমনতরো ‘অপমৃত্যু’র শিকার হচ্ছে।
যাক সে কথা। ‘গার্লস, নট ব্রাইডস’ (কনে নয়, মেয়ে) নামে একটা বিশ্ববিখ্যাত সংগঠন বাল্যবিবাহ নিয়ে প্রচুর কাজ করছে। ওখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, পৃথিবীর যে ২০টি দেশে বাল্যবিবাহের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ নম্বরে (৫২ শতাংশ); নাইজার প্রথম (৭৬ শতাংশ) আর কেমেরুনের অবস্থান সবচেয়ে নিচে (৩৮ শতাংশ)। প্রতিবছর বাংলাদেশে ৩৯ লাখ মেয়ে ১৮ বছরে পৌঁছার আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয় এবং ভারতে বসে প্রায় তিন কোটি।
অর্থাৎ প্রতিদিন বাংলাদেশে ১১ হাজার কোমলমতি মেয়েকে অতি অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে জীবনের আলো থেকে বঞ্চিত করা হয়।
দুই
সম্প্রতি এক হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশি মেয়েদের ৪০ শতাংশের বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সের আগে আর ৭৪ শতাংশের ১৮ বছরের আগে। যাদের ১৫ বছরের নিচে বিয়ে হয় তাদের এক-পঞ্চমাংশ ২৪ বছরে পৌঁছার আগেই দুই বা তিন সন্তানের মা হয়। তবে সুসংবাদ এই যে বাল্যবিবাহের গতি কিছুটা নিম্নমুখী।
যা হোক, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের প্রকট প্রকোপ একটা ধাঁধার জন্ম দেয়। প্রথমত, দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে বেশ সন্তোষজনক হারে, অথচ বাল্যবিবাহ তেমন হারে কমেনি। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে লিঙ্গবৈষম্য দূরীভূত হওয়ার কারণে কিশোরীদের ‘ভয়েস’ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। অনেকে মনে করেন, বাল্যবিবাহ রোধে শিক্ষা একটি শক্তিশালী প্রতিষেধক। অবশেষে নারীদের ক্ষমতায়ন যেখানে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে বাল্যবিবাহের অত্যন্ত বেশি প্রকোপ নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।
তিন
বাল্যবিবাহের প্রকোপ বাংলাদেশে যে অত্যন্ত বেশি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সুধীসমাজ তো বটেই, সরকারি নীতিনির্ধারকরাও প্রতিনিয়ত বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন। সম্ভবত সম্প্রতি সেই সূত্র ধরে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়নের একটা তাগিদ সমাজ থেকে সৃষ্টি হয়। প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন যে বালক ও বালিকা উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও বাল্যবিবাহ উৎসারিত উৎকট সমস্যা সবচেয়ে বেশি ঘিরে রাখে মেয়েটিকে, যার গর্ভে অত্যন্ত অল্প বয়সে সন্তান আসে, যে শিক্ষাঙ্গন থেকে ঝরে পড়ে এবং যে আক্রান্ত হয় নানা ধরনের রোগ-ব্যাধিতে।
চার
কন্যা কখন কনে হয়? শিশু বা বাল্যবিবাহের কারণ বহুবিধ। প্রথমত, এর অন্তরে গ্রোথিত থাকে লিঙ্গবৈষম্য। কোথাও কোথাও প্রচলিত ধারণা এই যে মেয়ে ও নারীর অবস্থান, যেকোনোভাবেই হোক, ছেলে ও পুরুষের চেয়ে নিচে। হিন্দি সিনেমার ভাষায় আওরাত ও মরদ; প্রথমজনের বসবাস দ্বিতীয়জনের আধিপত্যে আর প্রথমজন প্রজা তো দ্বিতীয়জন রাজা। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, সামাজিক ন্যায়-নীতির অভাব ও নিরাপত্তাহীনতা বাল্যবিবাহে জ্বালানি জোগায়। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর অনেক দেশে পরিবারগতভাবে বালিকা হচ্ছে বোঝা আর বালক হচ্ছে সম্পদ। বোঝাটাকে তার স্বামীর ঘরে হস্তান্তর করার মোক্ষম পথ হচ্ছে অতি অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা। তৃতীয়ত, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মূল্যবোধ বাল্যবিবাহকে উৎসাহিত করে। মেয়ে কিভাবে আচরণ করবে, কী পরিধান করবে, কার সঙ্গে দেখা করতে পারবে এবং কাকে বিয়ে করতে পারবে ইত্যাদি সিদ্ধান্ত আসবে পুরুষ থেকে। চতুর্থত, বাল্যবিবাহের সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগসূত্র থাকতে পারে প্রথাগতভাবে। এই প্রথা চলে আসছে, সুতরাং চলতে দিতে হবে। মেয়ের মা বা দাদির বিয়ে হয়েছিল ১৬ বছর বয়সে, সুতরাং মেয়ের বিয়ে ১৬-তে হবে তাতে ক্ষতি কী? পঞ্চমত, উন্নয়নশীল বিশ্বের দরিদ্র পরিবারের অর্ধেকের বেশি মেয়ের বিয়ে হয় বাল্যাকলে। দারিদ্র্য যখন প্রকট আকার ধারণ করে, তখন পরিবারের একমাত্র কর্তব্য দাঁড়ায় মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে খরচ হ্রাস করা। এমনি করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়ার মহৌষধ হচ্ছে বাল্যবিবাহ। মেয়েটি অন্যের বাড়িতে চলে যাওয়ার মানে একজন সদস্য কমে যাওয়া এবং অহেতুক খরচের সাশ্রয়।
অনেক ক্ষেত্রে বাল্য বয়সে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে যৌতুক পরিশোধের অন্যতম উপায়; এমনকি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব পরিহারের উপায় হিসেবে মেয়েকে বাল্যবিবাহ নামক বলি দেওয়া হয়। যে সমাজে মেয়ের যৌতুক বিদ্যমান, সেখানে বাল্যবিবাহ লোভনীয় অর্থনৈতিক উপায় হিসেবে আবির্ভূত হয়। সব শেষে, অনেক মা-বাবা সন্তানের নিরাপত্তা বিবেচনা করে অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দেয়; কখনো বা কোথাও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য বাল্যবিবাহের ব্যবস্থা করা হয়।
পাঁচ
‘গার্লস, নট ব্রাইডস’ বাল্যবিবাহের পরিণতি নিয়েও দু-একটা কথা বলেছে। প্রথমত, বাল্যবিবাহ মেয়েদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে এবং এটা মেয়েটির জীবনকে সহিংসতা ও নির্যাতনের মুখোমুখি দাঁড় করায়; এমনতরো বিবাহ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ফেলে দেয়। বাল্যবিবাহের কারণে টেকসই উন্নয়নের অন্তত ছয়টি লক্ষ্য সরাসরি হুমকির মুখে পতিত হয়। দৈহিক ও মানসিকভাবে স্ত্রী অথবা মা হওয়ার প্রস্তুতি না থাকার কারণে অল্পবয়সী কনেরা গর্ভকালীন বা সন্তান প্রসবের সময় সবচেয়ে জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়। শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সুযোগ কম থাকার কারণে এদের পরিবারগুলো দারিদ্র্য নিয়ে বসবাস করে। আর জাতিগত ক্ষতির দিক থেকে এই ক্ষতি কম নয়—একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবদানের অনুপস্থিতি প্রবৃদ্ধিকে সংকুচিত করে রাখে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বা রূপান্তর সম্ভব হয় না।
যদি ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন এবং মেয়ে ও নারীদের মানবিক অধিকার সমুন্নত রাখতে হয়, এই মুহূর্তে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেটা আসতে হবে পরিষ্কার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও যথাযথ নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’র আড়ালে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করা ঠিক হবে না। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ রোধে অতি সম্প্রতি যে আইনটির সুপারিশ করা হয়েছে তা কোনোমতে গ্রহণযোগ্য নয়, একমাত্র এই কারণে যে সেখানে ব্যতিক্রম ঘটনার সুযোগ রাখা হয়েছে। ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিবাহ নিষিদ্ধ—এটাই হওয়া উচিত প্রথম ও শেষ কথা।
প্রাপ্ত গবেষণা বলছে : (ক) বিয়ে এক বছর পিছিয়ে গেলে মেয়েদের স্কুলে অবস্থান ০.৬৮ বছর বৃদ্ধি পায় আর প্রথম বাচ্চা জন্মের বছর বৃদ্ধি পায় ০.৮৪ বছর। (খ) প্রায় চার-পঞ্চমাংশ মেয়ের বিয়ে হয় অভিভাবক কিংবা অন্যান্য আত্মীয়র মধ্যস্থতায়; এদের মধ্যে ৩৮ শতাংশ ১৫ বছরের নিচে আর ৭৭ শতাংশের বিয়ে হয় ১৮ বছরের নিচে। (গ) কেন বিয়ে হয়েছে—এই প্রশ্নের উত্তরে উত্তরদাতাদের মাত্র ৩ শতাংশ দৈহিক নিরাপত্তা নিয়ে মা-বাবার উদ্বেগের কথা জানিয়েছে; ৭২ শতাংশ বলেছে, প্রস্তাব এমন ভালো ছিল যে মানা করা যায় না। সুতরাং নিরাপত্তার অজুহাতে বাল্যবিবাহের পক্ষে সাফাই গাওয়ার যুক্তি যথাযথ নয়। (ঘ) অপ্রাপ্তবয়স্ক মায়েদের সন্তান খর্বকায় হওয়ার প্রবণতা বেশ বড়মাপে বৃদ্ধি পায়। (ঙ) ১৮ বছরের নিচে বিবাহিতদের প্রসবকালীন মৃত্যু ঘটে বেশি এবং ১৮ বছরের নিচে বিবাহিতদের দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের আশঙ্কা বেশি।
অতএব, শুধু আইন করে কিছু হবে না; বাল্যবিবাহ হ্রাস করতে হলে মেয়েদের লেখাপড়া স্নাতক স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক করতে হবে। মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিশু প্রতিরক্ষা পদ্ধতি ও সুষ্ঠুভাবে মেয়েদের জন্ম নিবন্ধন করতে হবে।
সারা বিশ্বে যত বাল্যবিবাহ হয়, তার বেশির ভাগ (৪০ শতাংশ) হয় ভারতে; যদিও বাল্যবিবাহ সেখানে অবৈধ। অন্যথা হলে এক লাখ টাকা জরিমানা ও দুই বছরের জেল। তার পরও মহাধুমধামে চলছে বাল্যবিবাহ। আইন করে কি এই মহাপ্রলয় ঠেকানো যাবে? বাল্যবিবাহ রোধে একদিকে যেমন আইন প্রণয়ন জরুরি, অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ জনমনে সচেতনতা সৃষ্টি। এ ক্ষেত্রে একটা শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়