মিজানুর রহমান (বাবুল) সম্পাদক সংবাদ এই সময়।
সম্প্রতি দেশে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা শুধু জনমনে আতঙ্কই সৃষ্টি করছে না, একই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার এক উদ্বেগজনক চিত্রও তুলে ধরছে। রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে, মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানায় ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আগুনের ঝুঁকি মোকাবেলায় আমরা কতটা পিছিয়ে আছি। অগ্নিকাণ্ডে দেশের অর্থনীতি, উৎপাদন ও অবকাঠামো মুহূর্তের মধ্যে শুধু বিপর্যস্তই হচ্ছে না, বরং হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে। দেশের শিল্পায়নের অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু এ উন্নয়নের ভিত যাদের শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা আজও সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে, ভয়াবহ এক বাস্তবতা। ২০১৮ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সাড়ে সাত বছরে শিল্প-কারখানায় ১৫২টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৩১ শ্রমিক ও আহত হয়েছেন ৫৭৮ জন। এছাড়া ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত পোশাক ও অন্যান্য কারখানায় কেমিক্যাল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে ১৩টির মতো। এটি কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি শ্রমিকের জীবনের প্রতি অবহেলা, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার জ্বলন্ত প্রমাণ। বাংলাদেশে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে জড়িত সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি আধুনিক প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ ও প্রতিক্রিয়ামূলক (কুইক রেসপন্স) প্রযুক্তি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
গত বৃহস্পতিবার অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ, বিলস, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), কর্মজীবী নারী ও সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি (এসআরএস) যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে শ্রমিকদের সুরক্ষায় সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ১২টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সংগঠনগুলো যেসব সুপারিশ করেছে, তা আসলে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও বঞ্চনার প্রতিফলন। প্রতিটি দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ, প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন, হতাহত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ বৃদ্ধি, দ্রুত বিচার, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সেফটি কমিটি গঠন, আইন সংশোধন—এসব দাবির কোনোটিই নতুন নয়। তবুও বছর ঘুরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এটি প্রমাণ করে যে নীতিনির্ধারক মহলে শ্রমিক সুরক্ষা এখনো অগ্রাধিকার পায়নি। দুর্ঘটনা ঘটলে গঠন হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু সেই কমিটির প্রতিবেদন কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে। কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয় না। দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার উদ্যোগ যেমন দেখা যায় না, তেমনি ভুক্তভোগী শ্রমিক বা তাদের পরিবারের পুনর্বাসনও নিশ্চিত হয় না। ফলে প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তৈরি হয় নতুন ট্র্যাজেডি। এর মূল্য দিতে হয় শ্রমজীবী মানুষ আর তাদের পরিবারকে।
শিল্প-কারখানা বা কোনো প্রতিষ্ঠান বা বাসাবাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে নিয়ন্ত্রণ করতেও বেগ পোহাতে হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরকে। শিল্প-কারখানাসহ বাসাবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সেই অনুপাতে ফায়ার সার্ভিসের আধুনিক প্রযুক্তি সক্ষমতা বাড়ছে না। প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে জনবল সংকটের পাশাপাশি সরঞ্জাম ঘাটতি। এতে অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির দায় নেই। এ দায় নানা সময়ে ক্ষমতায় থাকা সরকারের। তারা ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়াতে উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের জীবনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হয় না। সেপ্টেম্বরে গাজীপুরের টঙ্গীতে রাসায়নিকের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মী আহত হন ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারাও গেছেন। অথচ প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে আগুন নেভাতে মানুষের পরিবর্তে জিপিএস-নির্ভর রেসপন্স সিস্টেম, ড্রোন সার্ভিল্যান্স, হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়। পানির পরিবর্তে অগ্নিনিরোধক রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু দেশে আজও শোনা যায় পানির অভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরি হয়ে গেছে। কার্যকর রিজার্ভার সিস্টেমও গড়ে তোলা যায়নি।
আমাদের শিল্প-কারখানা ও বাসাবাড়ির প্রবেশের রাস্তাঘাট অপ্রশস্ত। ফলে এসব রাস্তাঘাট দিয়ে অগ্নিনির্বাপণ গাড়ি সহজে প্রবেশ করতে পারে না। এমনকি যানজটের কারণে অগ্নিনির্বাপক গাড়ি সময়মতো ঘটনাস্থলে যেতে পারে না। ফলে অগ্নিনিরাপত্তার ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দেয়। তাই অগ্নিনিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা উচিত।
বর্তমানে উন্নত বিশ্বের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে রিস্ক ম্যাপিং, প্রেডিক্টিভ মেইনটেন্যান্স ও স্মার্ট মনিটরিং টুল ব্যবহার করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সেন্সর আগেই সম্ভাব্য ত্রুটি শনাক্ত করে সতর্কবার্তা দেয়। ফলে বড় দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়। ড্রোন ও রোবটের মাধ্যমে নিয়মিত পরিদর্শন করে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা চিহ্নিত করা এখন আধুনিক শিল্প নিরাপত্তার অংশ। অগ্নি শনাক্তকরণ ব্যবস্থায় তাপ, ধোঁয়া ও গ্যাস ডিটেক্টর সংযুক্ত অ্যালার্ম সিস্টেম দ্রুত প্রতিক্রিয়ার সুযোগ করে দেয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া গেলে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব হয়। বড় শিল্প স্থাপনাগুলোয় অগ্নি নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী স্প্রিংকলার সিস্টেম, ফোম সিস্টেম, ইনার্ট গ্যাস সিস্টেম ব্যবহৃত হচ্ছে—যেগুলো আগুনের ধরন ও স্থানভেদে ভিন্নভাবে কার্যকর।
অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে রোবোটিক অগ্নিনির্বাপণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উচ্চঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অগ্নিনির্বাপণে রোবটের ব্যবহার এখন এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। এ প্রযুক্তি শুধু মানবজীবন রক্ষা করছে না, বরং দ্রুততর ও দক্ষতার সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হচ্ছে। ফ্রান্সের শার্ক রোবোটিকসের তৈরি ‘রাইনো প্রটেক্ট’ রোবটটি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তুলনামূলক ছোট ও হালকা এ রোবট দূরনিয়ন্ত্রিতভাবে কাজ করতে পারে। অগ্নিকাণ্ডের শুরুতেই দমকল বাহিনী আসার আগেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম। ট্যাবলেটভিত্তিক রিমোট কন্ট্রোল, রিয়েল টাইম ভিডিও ফিড ও সেন্সর ডাটার মাধ্যমে এটি সুনির্দিষ্টভাবে আগুনের উৎসে পৌঁছে নির্বাপণ কাজ সম্পন্ন করে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এরই মধ্যে এটি ব্যবহার হচ্ছে। এর মাধ্যমে অগ্নিনির্বাপণ কর্মীদের ঝুঁকি অনেক কমেছে ও আগুন ছড়ানোর আগেই তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের জরুরি মহড়ায় রোবট, ড্রোন ও সেন্সর প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। নিয়মিত ও বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মীরা আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠবে, যা ভবিষ্যতের বড় দুর্ঘটনা মোকাবেলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।